বাংলার ফুটবল থেকে সুব্রতরা কোনদিন অবসর নেবে না!
‘সুব্রতরা জীবনে কখনও অবসর নেবে না’।
১৯৮৭-এর ২৯শে আগস্ট কলকাতা লিগের ফিরতি বড় ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল মাঠে চিমার একাই হারিয়ে দিয়েছিল মোহনবাগানকে। আনন্দবাজারে মতি নন্দী লিখেছিলেন “সুব্রতর চোখে শুন্যতা”। প্রকারন্তরে সুব্রত ভট্টাচার্যকে অবসর নিতে বলেছিলেন তিনি। সুব্রত ভট্টাচার্য অবসর নেননি। বরং চিমাসমেত ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছেন লিগ, ডুরান্ড, রোভার্সে। ডিফেন্ডার হয়েও দু’বার ইস্টবেঙ্গলের জালে বল জড়িয়েছেন। নিজের পরিচিতদের কাছে বলেছিলেন, "যেদিন রিটায়ার করব সেদিন মতিদাকে কিন্তু আবার লিখতে হবে।”
লিখতে হয়েছিল মতি নন্দীকে। আটই সেপ্টেম্বর, ১৯৯০। বি এন আর-কে হারিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় মোহনবাগান। লিগে সেটাই ছিল সুব্রত ভট্টাচার্যের শেষবারের মোহনবাগানের হয়ে মাঠে নামা। সেদিন আনন্দবাজারে মতি নন্দী লিখেছিলেন, ‘সুব্রতরা জীবনে কখনও অবসর নেবে না’।
সেই লেখাটি এখানে দেওয়া হল।
‘সুব্রতরা জীবনে কখনও অবসর নেবে না’।
মতি নন্দী
"বাসটি পাশ দিয়ে যাবার সময় আরোহীদের দিকে তাকিয়েই তাদের জামার রঙ দেখে চিনে নিতে অসুবিধা হল না। মোহনবাগান ফিরে যাচ্ছে। জানালায় যাদের দেখতে পেলাম, তাদের মধ্যে একটি মুখ খুব পরিচিত। সুব্রত ভট্টাচার্য। উৎকট উল্লাসে তার চার-পাঁচ হাত দূর থেকে একটা "চিমা চিমা" হল্লা ছুটে চলেছে। চার-পাঁচ সেকেন্ডের জন্য আমি সুব্রতর চোখ দেখতে পেয়েছিলাম। সে চোখে রাগ নেই, দুঃখ নেই, পরাজয়ের গ্লানি নেই। বস্তুত কিছুই নেই। শুধু শূন্যতা। এমন বিশাল ব্যাপক, বোধরহিত শূন্যতা ভোরের আকাশে দেখা যায়”।
তিনবছর আগে কথাগুলো লেখার সময় যে অনুভবের মধ্যে ছিলাম, এই মুহূর্তে তার থেকেও বেশি বিষাদ বোধ করছি। সুব্রতর সেদিনের চাহনি বোধহয় এখন আমার চোখেই ভর করছে। আমি জানি ওই লেখায় তাকে খেলা থেকে অবসর নিতে বলায় সে আহত বোধ করেছিল। কিন্তু মনের বেদনা কঠিন সংযমে আড়াল রেখে সে তার সাংবাদিক বন্ধুদের তখন বলেছিল, "যেদিন রিটায়ার করব সেদিন মতিদাকে কিন্তু আবার লিখতে হবে। আমি জানি কখন অবসর নিতে হবে আর ঠিক সময়েই সেটা নেব।"
সুব্রত ভট্টাচার্য - ভারত, বাংলা ও মোহনবাগানের ডিফেন্ডার - শনিবার তার জীবনের শেষ লিগম্যাচ খেলতে নামছে। শুরু করেছিল ১৯৬৯-এ বালি প্রতিভায়। বাইশ বছর ধরে প্রথম ডিভিসনে সে খেলছে, তারমধ্যে সতেরো বছর মোহনবাগানেই।। কিন্তু এই তথ্য সুব্রতর খেলোয়াড় জীবনের পক্ষে খুব একটা বড় ব্যাপার নয়। সে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরে দেখিয়ে দিয়েছে, একটা মানুষ ফুটবল মাঠে শরীর ও মনকে কতদূর পর্যন্ত মিলিয়ে দিয়ে নিজেকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে। প্রদীপ ব্যানার্জি চমৎকারভাবে তিনটি শব্দে এটি বলে দিয়েছেন - জেদ, নিষ্ঠা, বাসনা।
সুব্রত ভট্টাচার্যের অনমনীয় জেদ আমি একটি ম্যাচে দেখেছিলাম, ২৪শে জুলাই, ১৯৭৬। ইস্টবেঙ্গল সেই ম্যাচ জিতলে টানা সাত বছর লিগ চ্যাম্পিয়ন হবে, মোহনবাগান জিতলে টানা ছয় বছর লিগ না জেতার গ্লানি থেকে বেরিয়ে আসবে। ১৫-২০ সেকেন্ডের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল গোল খেয়ে যাবার পর বাকি সময় খেলাটা হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল বনাম সুব্রত - প্রদীপ চৌধুরী। শরীরের ক্ষমতা আর হার না-মানা জেদ যে একটা মানুষকে দানবের মতো(ফুটবল দেবদূতদের জন্য নয়) বিশাল করে দেয়, কলকাতার ফুটবল মাঠে সুব্রতর সমসাময়িক কেউ দেখাতে পারেনি।
সুব্রতর স্কিল এবং টেকনিক্যাল বোধ তার সহজাত বুদ্ধি ও প্রভূত পরিশ্রম দ্বারা অর্জিত। নিরন্তর সে পরিশীলিত করেছে নিজের দক্ষতাকে এবং এর প্রকাশ দেখেছি ১৯৭৭ সেপ্টেম্বরে কসমসের সঙ্গে ম্যাচে। এমন স্থির মস্তিষ্কে, অসাধারণ অ্যান্টিসিপেসনে জমিতে ও শুন্যে সে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছিল, যা দেখে মনে হয়েছিল, ফুটবল তাহলে এত হিংস্রভাবে খেলা হয় কেন? এত আবেগ ভরে নিজেকে নিবেদন করে দেওয়া দেখলে মন প্রসন্নতায় ভরে যায়।
বস্তুত সুব্রত, দানবের মতো আবার আত্মমগ্ন শিল্পীর মতো, দুভাবেই নিজেকে মাঠের মধ্যে প্রকাশ করেছে। সে নিজেই নিজের জন্য একটা মানদন্ড তৈরি করে দিয়ে নিজের বিপদ তৈরি করে ফেলে। সেই মান থেকে বিচ্যুতি ঘটলেই আমাদের পক্ষে তা সহ্য করা শক্ত হয়ে পড়ে। আমার ধারণা, সুব্রত নিজেও তখন নিজেকে আর সহ্য করতে পারে না। যার প্রতিফলন তার মাঠের বাইরের আচরণে প্রকাশ পায়।
খেলার জন্য সুতীব্র বাসনাই যে তার চালিকাশক্তি, এটা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। বাইশ বছর প্রথম ডিভিসনে খেলা যাওয়া কি শুধুই টাকার হাতছানিতে সম্ভব? মোটেই নয়। টাকাপয়সা নিয়ে ইদানীং খেলোয়াড় সমাজে যে কদর্য মনোভঙ্গি দেখা দিয়েছে, আশ্চর্যভাবে সুব্রত ভট্টাচার্য তা থেকে মুক্ত। সে শুধু মাঠে নেমে খেলতে চায় এবং মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে। ফুটবলকে এইভাবে ভালবাসা, মাঝেমাঝে ওকে পাগল বলে মনে হয়। বছর দুই আগে রহড়া ঋত্বিকের উদ্যোগে পানিহাটি লোকসংস্কৃতি ভবনে গল্প পড়ার জন্য আমরা কয়েকজন কলকাতা থেকে যাচ্ছিলাম মোটরে। মাঝপথে গাড়ি বিকল। অসহায়ভাবে বি টি রোডে আমরা দাঁড়িয়ে। ধাবমান এক মোটর হঠাৎ সামনে থামল। “একি, আপনি দাঁড়িয়ে? চলুন পৌঁছে দিচ্ছি।” মোটরে ওঠার সময় মনে হয়েছিল, এই লোকটির সম্পর্কেই এক বছর আগে লিখেছিলাম, এবার মাঠ থেকে ওর অবসর নেওয়ার সময় হয়েছে।
আমি জানি সুব্রত ভট্টাচার্য সারাজীবনে কখনো অবসর নেবে না। এই ধরনের লোকেরা নিতে পারে না। জেদ, নিষ্ঠা আর বাসনা যার মজ্জায় ঢুকে যায় সে আজীবন আচমকা মোটর গাড়ি থামিয়ে বলবে “চলুন পৌঁছে দিয়ে আসি।”