পাকিস্তান ক্রিকেট কে কলঙ্কিত করার এক সেরা জায়গা!!


মনে আছে কি পাকিস্তানের!!
লাহোর ২০০৯: রক্তাক্ত ক্রিকেট !

থিলান সামারাবিরার চেয়ে সুখি মানুষ তখন আর দুনিয়ায় নেই।
করাচিতে আগের টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। লাহোরেও আগের দিন আরেকটা ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। রানের বন্যার মধ্যে আছেন। ফলে মেজাজটাও খুব ফুরফুরে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খুব চনমনে লাগছিলো। কেবলই মনে হচ্ছিলো, কারো পেছনে একটু দুষ্টুমি করা দরকার। বাসে উঠে বেছে বেছে তাই মুরালিধরণের পেছনের সিটে বসলেন। কেবলই মুরালিকে নানারকম ‘স্লেজিং’ করছিলেন আর হাসছিলেন। 
হাসিটা শেষ হলো না, কথাটা শেষ হলো না, উচ্ছ্বাসটা শেষ হলো না; বিকট শব্দ হলো কাছেই কোথাও। পাশ থেকে সাঙ্গাকারা বললেন, ‘পটকা বোধহয়’। পারানাভিতানা উচু হয়ে দেখতে গেলেন, কী হয়েছে। সাথে সাথেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির শব্দে কেঁপে উঠতে থাকলো বাস। সবাই বুঝতে পারলেন, বাজি নয়, বাস্তব জীবনের গুলি চলছে। বুঝতে পারলেন, জীবনের ভয়ঙ্করতম অধ্যায়ের ভেতর পড়ে গেছেন তাঁরা।
এক ঝাক স্পিলিন্টার এসে পিঠ ঝাজরা করে দিলো সামারাবীরার। মুখের হাসিটা তখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। কেবল বুঝতে পারলেন গুলির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে বাস।
সারা দুনিয়া কেপে উঠলো এই এক ঘটনায়। দুনিয়া জুড়ে খবর তখন একটাই-লাহোরে আক্রান্ত ক্রিকেট।
হ্যাঁ, ২০০৯ সালের এই ৩ মার্চের ঘটনা।
পাকিস্তান সফররত শ্রীলঙ্কা দলের ওপরে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিলো কোনো এক উগ্র গোষ্ঠী। এটাকে বলা চলে ক্রিকেট ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম এক অধ্যায়। কেবল শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলা, কিছু লোকের প্রানহানি; এখানেই সীমবদ্ধ ছিলো না এই ঘটনা। সারা ক্রিকেট দুনিয়াকে নতুন এক সন্ত্রস্ত যুগে নিয়ে গেছে এই এক হামলা। ক্রিকেটের ইতিহাসকে সম্ভবত দু ভাগে ভাগ করা যায়-লাহোর হামলার আগে ও পরে।
লাহোর হামলার প্রেক্ষাপটটা বুঝতে আমাদের আলাপ শুরু করতে হবে ২০০২ সাল থেকে।
এই বছর পাকিস্তান সফররতম নিউজিল্যান্ড দলের হোটেলের বাইরে আত্মঘাতি বোমা হামলা হয়েছিলো। যদিও এই নিউজিল্যান্ড দলই এর আগে শ্রীলঙ্কায় এরকম যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দু দফা পড়েছিলো। কিন্তু এবারের করাচি আক্রমণের ফলে পাকিস্তান এক ধরণের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে গেলো। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো কিছু দল ছাড়া পাকিস্তান সফর কার্যত বন্ধ করে দিলো ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ডের মতো দলগুলো। ২০০৭ সালে সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা পাকিস্তান সফর করেছিলো।
এরপর দেশটিতে আভ্যন্তরীন সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় প্রায় দু বছর পাকিস্তানে কোনো দল সফরে যায়নি। ২০০৯ সালের এই ফেব্রুয়ারি-মার্চে পাকিস্তান সফরের মূল সূচী ছিলো ভারতের। তারা যথারীতি সফরকে ‘না’ বলে দিলো। এই সময় পাকিস্তানের চিরকালের ক্রিকেটীয় বন্ধু শ্রীলঙ্কা এলো পাকিস্তান সফরে।
পাকিস্তান সরকার জানালো, এই সফরে শ্রীলঙ্কা দলকে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল নিরাপত্তা’ প্রদান করা হবে। সফরের শেষ টেস্টের আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো, এই নিরাপত্তার দরকার ছিলো না।
শেষ টেস্টের তৃতীয় সকালে সেই নরক নেমে এলো। 
শ্রীলঙ্কা দল হোটেল থেকে রওনা দিয়ে বিশাল কনভয় নিয়ে লিবার্টি স্কয়ারের কাছে পৌছে গেলো। এখান থেকে ডানে মোড় নিলেই পৌছে যাবে তারা গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের গেটে। আর এখানেই শুরু হলো অঝোরে গুলিবর্ষন।
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের আসলে বোঝার মত অবস্থা ছিলো না যে, কী হচ্ছে। তারা তখন সবাই বাসের মেঝেতে শুয়ে দু হাতে মাথা চেপে ধরে প্রাণরক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর আক্রমনকারীরা সমানে গুলি চালাচ্ছে বাস ও আগে-পেছনের নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরে। খুব দ্রুতই আক্রমনকারীরা সফলভাবে নিরপত্তাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারলো; কয়েক জন পুলিশের লাশ পড়ে গেলো।
এ অবস্থায় আক্রমনকারীদের প্রধাণ লক্ষ্য হয়ে দাড়ালেন বাসচালক মেহের খলিল। তাকে লক্ষ্য করে একটার পর একটা গুলি চালানো হলো। কিন্তু কোনোটা পাশ দিয়ে গেলো, কোনোটা কাচে আটকে রইলো, কোনোটা তার সিটে লাগলো। আশেপাশে এই প্রবল গোলাগুলির মধ্যেও প্রবলবেগে এক্সেলেটর চেপে ধরে রইলেন মেহের খলিল। একটা সেকেন্ডের জন্য তিনি বাস বন্ধ করেননি, গতি কমাননি; মাথাও নিচু করেননি।
শাই শাই করে এই গুলির ঝড়ের মধ্যেই বাস চালালালেন খলিল। গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের গেট খলিলের খুব পরিচিত। এখান থেকে বাস ঢুকাতে কয়েক বার চেষ্টা করতে হয়। আজ কি যেনো ভর করলো খলিলের ওপরে। বাসের গায়ে সামান্য আচড় না লাগিয়ে একবারে বাস নিয়ে এলেন পার্কিং লটে। ইঞ্জিন বন্ধ করে ক্লান্ত খলিল লুটিয়ে পড়লেন স্টিয়ারিংয়ের ওপরে।
ততোক্ষণে নিরাপত্তাকর্মীরা দূর্গ বানিয়ে ফেলেছেন গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। খেলোয়াড়দের স্কর্ট করে নিয়ে যাওয়া হলো ড্রেসিংরুমে। চিকিৎসকরা তৈরী ছিলেন। একমাত্র সামরাবীরা ছাড়া কারো আঘাতদ গুরুতর নয়। খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করা হলো।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফোর্স এসে পৌছালো। তাদের সাথে সাথে এলো এমআই-সেভেনটিন বিশাল হেলিকপ্টার। এই হেলিকপ্টার শ্রীলঙ্কান টিমকে নিয়ে উড়াল দিলো। বিমানবন্দর থেকে পরবর্তী ফ্লাইটেই তাদের নিয়ে যাওয়া হলো সরাসরি কলম্বোতে। আর এখানেই আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হলো।
শ্রীলঙ্কা দল প্রবল এক মানসিক যন্ত্রনা এবং মানসিক আঘাত ও শারীরিক কষ্ট নিয়ে রক্ষা পেলো এই ভয়াবহ আক্রমণ থেকে।
এবার শুরু হলো ঘটনার বিশ্লেষণ। খতিয়ে দেখার পর জানা গেলো পাকিস্তান পুলিশের ৬ জন সদস্য এবং দু জন বেসামরিক পথচারী নিহত হয়েছেন এই ঘটনায়। আহত হয়েছেন বিপুল সংখ্যক পুলিশ, ৬ জন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার এবং আম্পায়ার আহসান রাজা।
আসলে এই ঘটনাটি কেবল আহত, নিহতর এই পরিসংখ্যানে আটকে রইলো না। ঘটনার অনতিবিলম্বে একের পর এক নিন্দা আসতে শুরু করলো জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দূতাবাস থেকে। শুরু হলো তদন্ত এবং চাপানউতোর।
অন্তত তিনটি জঙ্গী গোষ্ঠী, একটি শ্রীলঙ্কান সশস্ত্র গোষ্ঠী, ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায় দিয়ে পরষ্পর বিরোধী সংবাদ আসতে থাকলো। কার্যত আজও এই ঘটনার পরিষ্কার দায়ীকে চিহ্নিত করা যায়নি। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়েছে যে, ক্রিকেট আর আগের দিনের মতো কেবল রোমান্টিক একটা ব্যাপার নেই।
এই ঘটনার পর প্রায় দশ বছর পাকিস্তানে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট নির্বাসিত ছিলো। দুনিয়ার সব প্রান্তেই ক্রিকেট দলগুলোকে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া শুরু হয় এই ঘটনার পর থেকে। বিশেষ করে উপমহাদেশে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের একেবারে নিরাপত্তার শেকলে আটকে ফেলা হয় এই হামলার পর থেকে।
তবে আশার কথা একটাই, এতোকিছুর মধ্যেও ক্রিকেট মাথা উচু করে টিকে আছে। সেই পাকিস্তানী বাসচালক মেহের খলিল এখন শ্রীলঙ্কার জাতীয় বীর, সেই আহসান রাজা এখনও আম্পায়ারিং করছেন, সেই পাকিস্তানে আবার ক্রিকেট হচ্ছে, সেই সামারাবীরা তারপরও ক্রিকেটে ফিরেছিলেন। এই সব ঘটনা আমাদের আশার বানী শোনায়।
ক্রিকেট এই সব আক্রমণের মধ্যে থেকেই ফিরে এসে বলে দেয়, সন্ত্রাস দিয়ে খেলা বা ভালোবাসা শেষ করে দেওয়া যায় না।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন