ইনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি জানেন কি ইনি কে!


ওকে সবাই 'পাগলী' বলতো, আর বলতো 'বাঁদরী'৷ ছোটবেলায় তো গ্রামের সকলে ওর মা বাবাকে বলেছিলো, এমন অদ্ভুত জীব ওরা আগে দেখেনি৷ কি না কি অমঙ্গল হবে, ওকে কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসতে৷ মেয়েটা খুব কম কথা বলতো, একা একা থাকতো বাধ্য হ'ত৷ আর গ্রামের বাচ্চা আর তাদের মা বাবাদের কটু কথা শুনে মাঝে মাঝে নিভৃতে বসে কাঁদতো৷ ওর মা, ধনলক্ষ্মী তখন ওকে কোলে টেনে নিতো, বাসি ভাত দিয়ে ওর পছন্দের মিঠি ভাত আর মুরগির মাংস রান্না করে খাওয়াতো৷ বন্ধুহীন একা, শান্তশিষ্ট মেয়েটার চোখের জল শুকাতো, কান্নার হিক্কা কমতো কিছু সময়ের জন্য৷ কিন্তু ফের আবার শুনতে হ'তো, খেপি, পাগলি, বাঁদরি, জানোয়ার, অমঙ্গল... 

মস্তিষ্কের গঠন ঠিক হয়নি বলে জন্ম থেকেই মেয়েটি অন্যদের থেকে আলাদা৷ কথা বলার ধরন, মত আদান প্রদানের ধরন, মেশার ধরন সব আলাদা৷ জন্মের সময় মাথাটি খুব ছোট্ট ছিলো, কান আর ঠোঁটের গড়নও কিয়ারা, জাহ্নবী, সারা বা দিশার মতো বা আপনার সুস্থসবল বাচ্চাটির মতো হয় নি৷ কিন্তু তার মনটা যে এক্কেবারে বালিকাদের মতো, এখনো। সে মিশতে চায়, পারে না৷ বলতে চায় পারে না৷ বন্ধু হতে চায় পারে না৷ যাদেরকে আপন করতে চায়, তাদের থেকেই নোংরা কথাগুলো শোনে, বিদ্রুপ শোনে। অসহায় হয়ে কাঁদে। কিন্তু সে যা পারে, তা আর কেউ পারে না৷ আর তার সেই গুণটাই 2010 সালে প্রথম আবিষ্কার করেন রুরাল ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন বা RDF এর PT কোচ, বিয়ানি ভেঙ্কটেশ্বরালু। দৌড়ে কি অনায়াসে হারিয়ে দিচ্ছে সুস্থ সবল বাচ্চাদের! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়েটি তো আঘাত পেতে পেতে নিরব হয়ে গেছে! সে তো কথাই বলতে চায় না কারো সাথে! ধীরে ধীরে বিয়ানি মেয়েটির কাছে আসার চেষ্টা করলেন৷ তাকে ট্র‍্যাকে দৌড়ানোর ব্যাপারে বোঝানোর চেষ্টা করলেন৷ তাও মেয়েটা ভুল করলো৷ ১০০ মিটারের স্টেট লেভেল জিতলেও পদক পেলো না, লেন জাম্প, মানে নিজের নির্দিষ্ট পথ থেকে বেরিয়ে অন্য প্রতিযোগীর পথে ঢুকে পড়ার জন্য ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে গেলো৷ কিন্তু হাল ছাড়লেন না বিয়ানি৷ অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে ওকে যতটা সম্ভব ট্রেনিং দিতে থাকলেন৷ 

হীরে মাণিককে কেউ চিনতে না পারলেও তার দ্যুতি সঠিক জহুরির নজর টানেই৷ 2019 সালে খাম্মামের স্টেট মিটে মেয়েটি নজরে পড়লো sports authority of India র কোচ N. Ramesh এর৷ তিনি মেয়েটির বাড়িতে এলেন৷ বাবা যোধাগিরি ও মা ধনলক্ষ্মীকে রাজি করালেন মেয়েকে হায়দ্রাবাদের SAI সেন্টারে পাঠাতে, ট্রেনিং এর জন্য৷ লড়াইটা সহজ ছিলো না৷ শুরু হ'লো এক্কেবারে প্রথম থেকে৷ হায়দ্রাবাদে যাওয়ার বাস ভাড়াই যে নেই গরীব কৃষক পরিবারটির কাছে! সে না হয় যোগাড় হ'লো, কিন্তু মেয়েটি যে সবার মতো নয়! ওকে দৌড়ের বিভিন্ন ট্যাকটিক্স, প্রতিযোগীদের দিকে নজর রাখা, ফোকাস রাখা ইত্যাদি বহু ব্যাপার বোঝানো ছিলো বড় কঠিন কাজ! ওর কোচেরা, ওর সহপাঠীরা ওর পাশে দাঁড়ালো৷ ধীরে ধীরে মেয়েটি সহজ হ'লো, তারপর শিখতে থাকলো৷ মন মাথা শরীর নিংড়ে শিখতে থাকলো, জড়িয়ে জাপ্টে নিতে থাকলো তার ভালোলাগার... বাঁচার... পেট ভরার এবং কি জানি হয়তো প্রতিশোধের অবলম্বনটা... দৌড়। 

কিন্তু পায়ে যে এখনো শিকল পরানো! দারিদ্রের৷ একদিন স্টেডিয়ামে নিজের মনে প্র‍্যাকটিস করছিলো মেয়েটি৷ দূর থেকে তাকে দেখছিলেন পুলেল্লা গোপিনাথন, ভারতের ব্যাডমিন্টন কোচ৷ মুগ্ধ বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ মেয়েটিকে দেখে উনি ডাকলেন কোচ রমেশ কে৷ জানলেন, মেয়েটি নাকি কখনো ক্লান্তির কথা বলে না, খিদের কথা বলে না, ব্যথা বা বিশ্রামের কথাও বলে না৷ সে শুধু তার অপরিনত মস্তিষ্ককে যতটা সম্ভব কাজে লাগিয়ে কোচের কথা শুনতে চায়, বুঝতে চায়, ট্র‍্যাকে সেগুলো কাজে লাগাতে চায়৷ সে শুধু দৌড়ে যায়। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে Gopichand Mytrah Foundation মেয়েটিকে স্পনসর করা শুরু করলো৷ 

তারপর? মেয়েটা দৌড়ালো না উড়লো৷ জাস্ট উড়ে গেলো ঐ 'বাঁদরি', 'পাগলি', 'জন্তু' ইত্যাদি শব্দগুলোকে অনেক নিচে ফেলে উড়লো। সব কান্না, সব অসহায়তাকে অনেক পিছনে ফেলে রেখে উড়লো৷ তার জিদ আর তার সরলসিধা, সোনার মতো দামী বালিকা মনটাতে ভর করে উড়লো সে, তার মা, বাবা, বোন, তার কোচেদের, তার সহখেলোয়াড়দের সাথে নিয়ে উড়লো সেই মেয়ে৷ সোনার মেয়ে৷ সে আরো উড়বে, মাটিতে পা রেখেই উড়বে৷ সে যে উড়তে পারে! সে যা পারে, আর তো কেউ পারে না!

শুধু তার কোচকে প্রতি ল্যাপে, প্রতি একশ মিটারের পরে হুইসেল বাজিয়ে মনে করাতে হয়, 'দীপ্তি, আরো এক পাক, আরো জোরে, আরও...' 

দীপ্তি উড়তে থাকে, আলো ছড়াতে থাকে৷ সোনালী স্বপ্নের আলো৷ 

...........

Vidyasathi  দীপ্তিকে অনেক অনেক অভিনন্দন আর আগামীর শুভকামনা জানায়। তার সাথে সাথে শ্রদ্ধা জানায় তার সব শিক্ষকদের যাদের ছাড়া এই উড়ান সম্ভব হতো না।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন